ঘটনাটা ঘটল রাত এগারোটার সময় কলকাতা থেকে দেশে যাচ্ছি। দেশ ঘ বলতে যেখানে আমি জন্মেছি। কলকাতা থেকে ট্রেনে যেতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগে।
সকাল পাঁচটায় একটা ট্রেন আছে। তাতে গেলে মাজদিয়া রেলস্টেশনে সকাল আটটা সাড়ে আটটা বেজে যায়। স্টেশনে নেমে আরও পাঁচ ক্রোশ হাঁটা। খুব তাড়াতাড়ি হাঁটলেও তাতে সময় লাগে আরও দু ঘণ্টা।
তারপর আর একটা ট্রেন আছে। সেটা ছাড়ে সকাল ন'টায়। তারপর দুপুর দু'টোয়। তারপর সন্ধ্যে ছ'টায়।
সন্ধ্যে ছ'টার ট্রেনে গেলে রাত ন'টায় পৌঁছতে পারা যায় মাজদিয়া স্টেশনে, কিন্তু তাতে গেলে বাড়ি পৌঁছতে রাত এগারোটা বেজে যায় বলে সাধারণত সে ট্রেনে যাই না। তখন আমি কলকাতার একটা মেসে থেকে পড়াশোনা করি।
প্রত্যেক শনিবার দুপুর দু'টোর ট্রেনে দেশে যাই। তাতে সুবিধে খুব। ট্রেনে ভিড়ও কম থাকে। আর সন্ধ্যের আগেই বাড়িতে পৌঁছান যায়।
কিন্তু সব সময় সে ট্রেনে যাওয়ার সুবিধে হয় না। লেখাপড়া ছাড়া ফুটবল খেলার নেশা আছে। রবিবার দিনটায় দেশে না কাটিয়ে কলকাতায় বন্ধুবান্ধবদের সাথে কাটাতে ভাল লাগে।
কোনও শনিবার বাড়িতে না গেলে বাবার চিঠি আসে। লেখেন- "তুমি শনিবার বাড়ি আস নাই কেন? আমরা পথ চাহিয়া বসিয়া ছিলাম, তোমার শরীর খারাপ হইল কিনা ভাবিয়া খুব চিন্তিত আছি। পত্রপাঠ উত্তর দিবে ইত্যাদি আমি বাবার একই সন্তান। বাবার বয়স হয়েছে। আমাকে নিয়ে তাঁর যত ভাবনা- চিন্তা স্বপ্ন সব কিছু। আমি বড় হব, আমি মানুষ হব, বংশের মুখ উজ্জ্বল করব।
কিন্তু ততদিনে আমারও একটা নিজস্ব জগৎ গড়ে উঠেছে। দেশের চেয়ে কলকাতার আকর্ষণই আমার কাছে বেশী। আমার জন্যে বাবা মোটা হাত খরচ পাঠান। সেই দিয়ে আমি ময়দানে ফুটবল খেলা দেখি, ক্রিকেট খেলা দেখি, আবার কখনও কখনও সিনেমা দেখতে যাই। কলকাতার জীবন গ্রামের জীবনের মত একঘেয়ে নয়। সেখানে চারিদিকে এঁদো পানাপড়া পুকুর আর কেবল খেত খামার আর বন জঙ্গল। আমাদের মত যাদের অবস্থা ভালো নয় তারা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কেবল বারোয়ারী-তলায় বটগাছের ছায়ায় হারুমুদির দোকানের মাচায় বসে আড্ডা মারে। তাস খেলে। আর আমি গেলে তারা আমার কাছে কলকাতার গল্প শোনে। কারোর কোন কাজ নেই। বাড়ির অবস্থা খারাপ বলে তারা কলকাতায় আসতে পারে না। সে পয়সা তাদের নেই। তাই আমাকে তারা একটু একটু হিংসেও করে। আমার চালচলন জামা প্যান্ট দেখে তারা অবাক হয়ে যায়।
আমার জুতো, আমার চুল ছাঁটা, আমার সাবান মাখা দেখে তাদের তাক লেগে যায়। কারণ আমাদের গ্রাম এমন এক গ্রাম যেখানে শহরের কোনও সভ্যতা ঢোকবার সুযোগ পায় নি।
আমাদের বাড়ির পাশেই থাকতেন নসুকাকা। আসল নাম বোধ হয় ছিল নৃসিংহ ভট্টাচার্য। বাবা তাঁকে নসু বলে ডাকতেন। তিনি গ্রামে গ্রামে যজমানদের বাড়িতে গিয়ে পূজো করে বেড়াতেন। বড় ভাল লোক। আমি দেশে গেলেই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। বলতেন, "কী রকম লেখাপড়া হচ্ছে বাবা?
ভাল তো?"
আমি তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতাম। বলতাম "হ্যাঁ"। তিনি বলতেন, "হ্যাঁ, খুব মন দিয়ে লেখাপড়া করবে বাবা। এখন দিনকাল খুব খারাপ, আর কলকাতা শহরে যে রকম গাড়ি-ঘোড়া-ট্রাম-বাস শুনেছি, খুব সাবধানে চলাফেরা করবে।"
নসুকাকা আমাদের দেশের নামকরা পুরুত মশাই। তিনি না হলে কারোরই কোন পূজো-আচ্চা হতো না। কেউ হাতে খড়ি দেবে তাতেও যেমন ডাক পড়তো, আবার তেমনি কারো বাড়িতে ছেলের অন্নপ্রাশন হবে তাতেও তাঁকে চাই। তারপর আছে বারোয়ারি তলার দুর্গাপূজো, কালীপূজো থেকে আরম্ভ করে তিন ক্রোশ দূরে জমিদার বাবুদের বাড়িতে যত উৎসব, যত বিয়ে, ব্রত উদ্যাপন, সবেতেই তাঁর ডাক পড়ত, তা এই আবহাওয়াতে আমি মানুষ। কিন্তু এই আবহাওয়াতে মানুষ হয়েও যে ঘটনা ঘটল তার কথাই বলি।
কলকাতায় তখন আমার স্কুলের পরীক্ষা চলছিল। তিন সপ্তাহ দেশে যেতে পারিনি। বাবাকে সে কথা লিখে দিয়েছিলাম যে, আমি তিন সপ্তাহের জন্য দেশে যেতে পারব না।
পরীক্ষা যেদিন শেষ হল সেদিন শনিবার। মেসে এসে ভাবলাম দু'টোর ট্রেন ধরব। কিন্তু কয়েকদিন ধরে রাত জেগে পড়বার পর বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ঘড়িতে বেলা সাড়ে বারোটা। ভাবলাম আধ ঘণ্টা ঘুমিয়ে নেওয়া যাক।
কিন্তু যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখলাম দেয়াল ঘড়িতে বেলা সাড়ে তিনটে। আমার বন্ধু যে আমার পাসের বিছানায় শুত, সেও দেখলাম অঘোরে ঘুমুচ্ছে।
মনে হল সর্বনাশ! দুটোর গাড়ি তো কখন ছেড়ে দিয়েছে। এরপরে তো সেই সন্ধ্যে ছ'টার আগে দেশে যাওয়ার আর কোনও গাড়ি নেই। সে গাড়িতে গেলে দেশের বাড়িতে পৌঁছতে তো সেই রাত এগারোটা বেজে যাবে।
কিন্তু শেয়ালদা স্টেশন থেকে গাড়ি ছাড়তেই সেদিন কেন জানি না আধ ঘণ্টা দেরি হয়ে গেল। ভাবলাম ট্রেনটা হয়তো একটু দেরি করেই মাজদিয়াতে পৌঁছবে। তার মানে যখন পাঁচ ক্রোশ হেঁটে বাড়ি পৌঁছব তখন রাত বারটা বেজে যাবে।
বাবা হয়তো বকাবকি শুরু করে দেবেন। বলবেন দুপুর দু'টোর ট্রেনে আসতে পারলে না?
কিন্তু না, ট্রেনটা ঠিক সময়েই মাজদিয়া স্টেশনে গিয়ে পৌঁছল।
আমি নিশ্চিন্ত হয়ে গেলাম। এদিককার প্লাটফর্ম ছেড়ে উলটো দিকের প্লাটফর্মে পৌঁছে টিকিট দেখিয়ে গেট পার হলাম। বেশী যাত্রী ছিল না ট্রেনে। গেটের বাইরেই বাজার। অত রাত বলেই বাজারের লোকজনের ভিড় বেশ পাতলা। তাড়াতাড়ি বাজার ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে পৌঁছলাম। ভেবেছিলাম একটা সাইকেল রিকশা ভাড়া করে বাড়ি পৌঁছব।
কিন্তু কোন রিকশাওয়ালাই অতদূরে যেতে চাইলে না। বেশি টাকার লোভ দেখিয়েও কাউকে রাজী করাতে পারলাম না। সবাই-ই এক কথা বললে অতদূরে সওয়ারি নিয়ে গেলে ফিরে আসতে রাত একটা বেজে যাবে।
আমি বললাম- আমি তোমাদের ডবল ভাড়া দেব।
তবু কেউ যেতে রাজি হল না।
অগত্যা হাঁটতে শুরু করলাম। হাতে অনেক জিনিস ছিল আমার। বাবা কাসির ওষুধ কিনে নিতে লিখেছিলেন। শেয়ালদা স্টেশন পৌঁছবার আগে ওষুধের দোকান থেকে তা কিনে নিয়েছিলাম। মা'র জন্য নিয়েছিলাম হাজা'র মলম। মা'র পায়ে হাজা হয়েছিল। তারপর গামছা কিনেছিলাম একটা বাবার জন্য।
আরও অনেক খুচরো-খুচরো জিনিস কিনেছিলাম-যা যা বাবা কলকাতা থেকে কিনে নিয়ে যেতে বলেছিলেন।
রাস্তা দিয়ে একলা একলা হেঁটে চলেছি। চারিদিকে নিশুতি অন্ধকার। রাতে গ্রামের লোকজন সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়ে। কারণ ভোর ভোর উঠতে হয় সকলকে। বড় বড় গাছগুলোকে দূর থেকে অন্ধকারে পাহাড় বলে মনে হচ্ছে।
খানিক দূর গিয়েই পিচের রাস্তা শেষ হয়ে গেল। আকাশে যে চাঁদটা ছিল তাও ডুবে গেল। তখন শুধু তারাগুলো জ্বলছে মাথার ওপর। মাঝে মাঝে শেয়ালের হুক্কা-হুয়া কানে আসছে। দু-একটা কুকুর আমাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল। কিন্তু আমাকে চিনতে পেরে আবার চুপ করে গেল। তবু আমার কেমন যেন ভয় করতে লাগল। কিন্তু কিসের যে ভয় তা বলতে পারব না।
একটা রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। চারদিকে কয়েকটা বড় বড় বটগাছ ডালপালা ছড়িয়ে জায়গাটিকে ঢেকে রেখেছে। শনি মঙ্গলবার ঐ জায়গায় হাট বসে। হাট বেলাবেলি শেষ হয়ে গেছে। চারদিকে ছোট-খাট দোকান। তারাও দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে তখন যে যার বাড়ি চলে গেছে।
বহুদিন আগে ওই বটগাছের ডালে একজন মানুষ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল! সে ছোটবেলাকার ঘটনা। কিন্তু তখন থেকেই জায়গাটায় এসে দাঁড়ালেই দিনের বেলাতেও কেমন গা ছম ছম করত। আর এখন তো রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে।
মনে পড়ল, বাবা-মা বোধহয় এতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছেন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল। তাঁরা ভাবছেন আমি আর আসব না। মা আমার জন্য ভাত রান্না করে বসে ছিল। বাবা বলছেন-আর কেন বসে আছ, খোকা আজকে বোধহয় এল না, তুমি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ো।
মাও বোধহয় তখন খেয়ে নিয়েছে। তারপর আমার কথা ভাবতে ভাবতেই বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই হেঁটে চলেছি। রাত তখন এগারোটা বেজে গেছে। রাস্তাটা গিয়ে নলগাড়ির নাবালে গিয়ে মিশেছে। আগে এখানে একটা নদী ছিল।
আগে যখন নদীতে জল ছিল তখন খেয়া নৌকায় এপারওপার করতে হত। কিন্তু এখন নদীটা শুকিয়ে গিয়েছে। সেখানে ঢালু জমিতে এখন চাষবাস হয়। তারই একপাশ দিয়ে গরুর গাড়ি যাবার রাস্তা হয়েছে। বর্ষার পর গরম পড়াতে রাস্তায় আবার ধূলো জমেছে। এখনকার লোক তাই ও জায়গাটার নাম দিয়েছে- 'নলগাড়ির নাবাল'।
আমি ঢালু রাস্তায় নামতে লাগলাম। তারপর সামনের দিকে নজর পড়তেই যা দেখলাম তাতে আমার শরীরের রক্ত হিম হয়ে এলো। দেখলাম ওপারের রাস্তা দিয়ে একটা দাড়িওয়ালা মূর্তি ঢালু রাস্তা দিয়ে আমার দিকে নেমে আসছে। রাস্তায় তার পা নেই, শুধু হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।
আমি আর এগোলাম না। এগোতে ভয় করল। ও কি তবে সেই লোকটার মূর্তি, যে একদিন বট গাছে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল? তখন কত লোকের মুখে শুনতে পেতুম যে, সে নাকি ঐ অঞ্চলে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু আমি নিজের চোখে কখনো তো দেখিনি।
হঠাৎ আমাকে লক্ষ্য করে মূর্তিটা কথা বলে উঠল।
বললে, "কে ওখানে?"
আমি কী জবাব দেব বুঝতে পারলাম না। শুধু একটু থেমে বললাম, "আমি।"
"আমি কে?"
বলতে বলতে মূর্তিটা আমার দিকে আরও এগিয়ে আসতে লাগল।
সামনে মুখের কাছে এসে বললে, "কে, কে তুমি?"
আমি ভয়ে শিউরে উঠেছি তখন। কিছুই জবাব দিতে পারলাম না সেই মুহূর্তে।
মূর্তিটা জিজ্ঞেস করলে, "ও তুমি! বিমল! ধীরেশদার ছেলে?"
আমার তখন জ্ঞান ফিরে এলো। চিনতে পারলাম মূর্তিটাকে।
বললাম, "নসুকাকা, আপনি?"
নসুকাকা বললেন, হ্যাঁ, আমি। তা তোমার আসতে এতো দেরী হলো যে? বললাম, "দুপুর দুটোর ট্রেনটা ধরতে পারিনি, ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, তাই সন্ধ্যে ছ'টার ট্রেন ধরে আসছি।"
নসুকাকা বললেন, "তা, আজকে এই অমাবস্যার রাতে না এলেই পারতে! এই রাত বিরেতে আসা কি ভাল? আমাদের গাঁয়ে যে পরশুদিন বাঘ বেরিয়েছিল। তার ক'দিন আগে বাবুদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল।"
বললাম, "তা আপনি এত রাত্তিরে কোথায় যাচ্ছেন?"
নসুকাকা বললেন, "জমিদারবাবুর স্ত্রী হঠাৎ ডেকে পাঠিয়েছেন। তাঁর বড় ছেলের খুব অসুখ, আমাকে সেখানে গিয়ে শান্তি স্বস্তেন্ করতে হবে। যত রাতই হোক না কেন আমাকে যেতেই হবে। তাঁর বড় ছেলে এখন-যায়-তখন-যায় অবস্থা। তাই খেয়ে নিয়েই দৌড়চ্ছি। আমাকে যে ডাকতে এসেছিল তাকে বলেছি, তুমি এগিয়ে যাও, আমি খেয়ে উঠেই যাচ্ছি, তোমার সঙ্গে রাস্তায় কোনও লোকের দেখা হয়নি?"
আমি বললাম, "কই, না তো-।"
নসুকাকা বললেন, "তা রাত্তির বেলা হয়তো ঠাহর হয়নি তোমার। তা, তুমি বাবা একলা এত রাত্তিরে এসে ভাল করোনি। চলো, আমি তোমাকে গাঁ পর্যন্ত পৌঁছে দিই।"
বললাম, "আপনি আবার কেন এত কষ্ট করতে যাবেন! আপনারও তো তাড়াতাড়ি আছে?"
নসুকাকা বললেন, "সে কী কথা! এই এত রাতে তোমাকে কি এই অবস্থায় একলা ছেড়ে দিতে পারি? শুনলে ধীরেশদা যে আমার ওপর রাগ করবে। বলবে, তুমি খোকাকে ওই অবস্থায় একলা ফেলে কী করে চলে গেলে!"
কী আর করা যাবে! ওদিকে জমিদারবাবুর বাড়ি তাঁর ছেলের এখন-যায়- তখন-যায় অবস্থা, আর তিনি কিনা আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চান? রাস্তায় যেতে যেতে নসুকাকা বলতে লাগলেন, "তুমি তিন সপ্তাহ বাড়ি আসনি, সেজন্য ধীরেশদা খুব ভাবছিলেন। কলকাতায় থাক তুমি, তোমার বয়েস হয়েছে। তোমার যত পড়াশোনাই থাক, হপ্তায় একদিনের জন্য বাবা-মাকে দেখতে আসতে পার না? তুমি যখন বড় হবে, আর নিজে বাবা হবে, তখন বুঝবে ছেলেকে দেখতে না পেলে মনে কী কষ্ট হয়!"
আমি নসুকাকার কথা শুনে কথার কোনও জবাব দিতে পারলাম না। চুপ করে নসুকাকার সঙ্গে চলতে লাগলাম। তারপর যখন বাড়ির কাছাকাছি এসেছি তখন নসুকাকা বললেন, "ওই দেখ, তোমাদের বাড়ি, এবার আর কোন ভয় নেই, আমি চলি আমার খুব তাড়া আছে।"
বলে তিনি চলে গেলেন।
আমি আমাদের বাড়ির সদর দরজায় কড়া নেড়ে ডাকতে লাগলাম, "বাবা, বাবা, বাবা।"
বাবা আমার ডাক শুনেই ধড়ফড় করে জেগে উঠেছেন। মাও জেগে উঠেছেন। তাড়াতাড়ি দরজা দিয়ে আমাকে দেখে বললেন, "খোকা তুমি এসে গেছ? কোন ট্রেনে এলে? দুপুরের ট্রেনে আসতে পারলে না?"
বললাম, "দুপুরবেলা পরীক্ষা দিয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম তাই" বাবা বললেন, "তা বলে সন্ধ্যের ট্রেনে আসতে হয়? জানো বাড়ি পৌঁছতে রাত এগারটা বেজে যাবে। তা ছাড়া গাঁয়ে পরশুদিন বাঘ বেরিয়েছিল, তা জানো? ক'দিন আগে বাবুদের বাড়ি ডাকাত পড়েছিল-"
আমি বললাম, "আমি তো তা জানতাম না। রাস্তায় দেখা হয়ে গেল নসুকাকার সঙ্গে। তিনিই আমাকে নিজে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন।
"নসু? নসুকাকা?"
বললাম, "হ্যাঁ, তাঁর সঙ্গে নলগাড়ির নাবালে দেখা হয়ে গেল। তিনি জমিদার বাবুদের বাড়ি যাচ্ছিলেন, তাদের বড়ো ছেলে মরো মরো, তাই তিনি শান্তি সস্তেন্ করতে সেখানে যাচ্ছিলেন।"
বাবা আমার দিকে হতবাকের মতো চেয়ে রইলেন।
মা-ও অবাক।
বাবা বললেন, "তুমি ঠিক দেখেছ? তোমার নসুকাকা? তিনি তোমার সঙ্গে কথা বলেছেন? তুমি কি আবোল-তাবোল বকছ?"
আমি বললাম, "বা রে, আমি ভুল দেখব কেন? আমি নসু কাকাকে চিনতে পারব না?"
বাবা বললেন, "কিন্তু তোমার নসুকাকা যে পরশু দিন মারা গিয়েছেন, আমরা যে নবদ্বীপে গিয়ে তাঁর সৎকার করে এলুম।
No comments:
Post a Comment