তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তিথিটা বোধ হয় অমাবস্যা।
পায়ের কাছে সমুদ্র গর্জন করছে। অন্ধকারে ভয়ংকর সুন্দর দেখাচ্ছে উঁচু উঁচু ঢেউগুলিকে। পাশেই বোধ হয় কোথাও একটা জলা ছিল। এক ঝাঁক হাঁস সমুদ্রের দিক থেকে কলরব করতে করতে আকাশপথে ফিরছে। অদ্ভুত দেখাচ্ছিল তাদের শ্রেণীবদ্ধ ছায়ামূর্তিগুলি।
আমাদের আলোচনা সুরু হয়েছিল বোধ হয় সাহিত্য নিয়ে! সেখান থেকে রাজনীতি এবং তারপরে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এটন বোমা ও হাইড্রোজেন বোমায় এসে পড়ে। কিন্তু সেখান থেকে কি করে যে ভূতের গল্পে এসে পৌঁছল জানি না। হয় তো সেই অন্ধকার রাত্রি, কালো কালো দৈত্যের মতো তরঙ্গের গর্জন এবং অন্ধকার আকাশে বলাকার ছায়ামূর্তিগুলোর ডানার শব্দের সঙ্গে কলরব, সমস্ত মিলিয়ে অপার্থিব একটা কিছু ছিল যা' আমাদের মনগুলোকে আর একটা অপার্থিবের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
প্রশ্ন উঠল, ভূত আছে কি নেই?
এ প্রশ্নে অনন্তকাল থেকে যে মতভেদ চলে আসছে আমাদের মধ্যেও তার অভাব ঘটল না। একজন বললেন, ভূত নিশ্চয়ই আছে। মৃত্যুর পরে মানুষের দেহ পঞ্চভূতে মিলিয়ে যায়, কিন্তু আত্মা থাকে।
আর একজন বললেন, ওসব বাজে কথা। মানুষ ভয়ে ভূতের কল্পনা করে, হয়তো ছায়া দেখে, নয়তো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো কোথাও পড়েছে, তাই দেখে। ভূত নেই।
তর্ক উদ্দাম হয়ে উঠল, ক্রমে এলোমেলো হয়ে এল। যুক্তি বলে যার কিছু রইল না।
মিঃ চক্রবর্তী তাঁর পাইপটা মুখে দিয়ে নিঃশব্দে সমস্ত শুনে যাচ্ছেন। একবার সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেশলাই জ্বালতেই মনে হল, তাঁর চোখ বন্ধ, ঠোঁটের ফাঁকে কৌতুকের হাসি।
জিজ্ঞাসা করলাম, মিঃ চক্রবর্তী, আপনি কথা কইছেন না যে! ভূত সম্বন্ধে আপনার কি অভিমত?
চক্রবর্তী এতক্ষণে সোজা হয়ে বসলেন। পাইপটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে সেই অন্ধকারে সকলের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন।
তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা ভূত দেখেছেন কেউ?
কারও মুখে কথা নেই। যাঁরা ভূতের পক্ষে আর যাঁরা বিপক্ষে সকলেই স্তব্ধ।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, জ্যান্ত না মরা?
সবাই হেসে উঠল: ভূতের আবার জ্যান্ত-মরা কি?
আমি বললাম, আছে বই কি! মানুষ মরে ভূত হয়, আবার ভূত মরে মানুষ হয়। তা 'হলে জ্যান্ত-মরা থাকবে না? আমি মরা ভূত দেখেছি, জ্যান্ত ভূত দেখিনি।
-বুঝলাম। -তারপর অন্যদের দিকে চেয়ে চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করলেন- আপনারা কেউ দেখেছেন?
একজন ঢোঁক গিলে বললেন, আমি নিজের চোখে দেখিনি অধনা। কিন্তু-
চক্রবর্তী গম্ভীরভাবে বাধা দিয়ে বললেন, না। আমি অনেষর চোবে সেগার কথা বলছি না। নিজের চোখে কেউ দেখেছেন শিল্প জিগ্যেস করাই।
কেউ উত্তর দিতে পারলেন না। সবাই চুপ করে বসে রইলেন।
চক্রবর্তী তখন বললেন, আপনারা কেউ দেখেননি। কিন্তু আমি দেখেছি নিজের চোখে।
-দেখেছেন?- যাঁরা ভূতের পক্ষে তাঁরা সমস্বরে চীৎকার করে উঠলেন,- বলুন, বলুন। শোনা যাক আপনার কাহিনী।
একটু চুপ করে থেকে চক্রবর্তী তাঁর কাহিনী আরম্ভ করলেন। ভদ্রলোক গল্প বলতে ওস্তাদ। তিনি যেমন বলেছিলেন, আমি ঠিক তেমনি তেমনি তোমাদের শোনাচ্ছি।
চক্রবর্তী বলতে লাগলেন:
আমি তখন দার্জিলিঙের ম্যাজিস্ট্রেট। একে জায়গাটি রমণীয়, তার উপর কাজকর্ম কম। সুতরাং বেশ আছি। একবার করে কাছারি যাই, আর অবশিষ্ট সময় চারদিকে ঘুরি-ফিরি।
এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাত: হুকুম এল বদলীর।
বদলীর চাকরী। সুতরাং বদলীর জন্যে সাধারণতঃ আমরা তৈরিই থাকি। কিন্তু দার্জিলিঙের পরিবেশে এমন একটা কি আছে, যা' মানুষকে ঘিরে রাখে আরামে, আনন্দে। চলে যাওয়ার কথা ভুল হয়ে যায়।
আমারও তাই হয়েছিল। কোথাও একটি বদলীর হুকুম যে-কোনো সময় আসতে পারে, এটা জানা থাকা সত্ত্বেও যখন হুকুম এল, তখন আমি চমকে উঠলাম। যেন এখান থেকে কোনোদিন কোথাও বদলীর কথা ছিল না। মনে মনে বিব্রতই বোধ করলাম।
কিন্তু উপায় কি! নির্দিষ্ট দিনে সেখানে পৌঁছতেই হবে।
জায়গাটার নাম আর করব না। মনে করুন, উত্তরবঙ্গের কোনো একটি জেলার সদর। ছেলেমেয়েদের দার্জিলিঙে রেখে আমি যথাসময়ে একাই রওনা হলাম সেখানে। সঙ্গে দুটি স্যুটকেস, একটি বিছানা আর আমার পুরাতন ভৃত্য গিরিধারী।
সন্ধ্যাবেলায় পৌঁছলাম। তখন ভালো বুঝতে পারিনি। সকালে উঠে দেখলাম,
চমৎকার নির্জন জায়গায় প্রকাণ্ড হাতার মধ্যে বাংলোটি। আশে-পাশে কোথাও বসতি নেই। দূরে পুলিস সাহেবের বাংলো। রাত্রে তারই আলো টিম টিম করতে দেখেছি। একটু দূরেই নদী। বাংলোর তিন দিক ঘুরে বয়ে চলেছে।
সামনে, নদীর ওপারে স্নানের ঘাট। ওপারের গ্রামের লোকেরা স্নান করে।
শাশানঘাট। মফস্বল শহরের শশ্মশানে কলকাতার মতো সকল সময়ে চিতা
দিনের বেলায় মাঝে মাঝে ধোঁয়া দেখা যায়। রাত্রে চিতার আগুন চোখে পড়ে। আমার বাংলোর প্রায় পাশ দিয়েই শ্মশানে যাবার রাস্তা। সুতরাং শববাহীদের হরিধ্বনি বেশ জোর শোনা যায়।
আগেই বলেছি বাংলোটা বেশ বড়। অনেকগুলো বেশ বড় বড় ঘর। আমি একা এসেছি। অত ঘরের কোনো দরকার ছিল না। যে-ঘরটার সঙ্গে কলঘর সংযুক্ত সেইটেকে শোবার ঘর করলাম। আর তার পাশের ঘরটি অফিস। আসবাবপত্র দেখে বোঝা যায় আমার আগে যিনি এই বাংলোয় ছিলেন তিনিও তাই করেছিলেন।
সকালবেলায় পুলিশ সাহেব এলেন। তিনি বললেন, আপনার বাংলোয় দু'জন সশস্ত্র পুলিস নিযুক্ত করলাম। একটু পরেই তারা আসবে।
বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, 'দু'জন সশস্ত্র পুলিশ! কি ব্যাপার! চোর- ডাকাতের ভয় আছে নাকি?
একটু ইতস্ততঃ করে ভদ্রলোক বললেন, না। চোর-ডাকাত ঠিক নয়। তবু কি জানেন, একেবারে মাঠের মধ্যে বাংলো। একটু সতর্ক থাকা ভালো।
আমি হাসলাম। আমার সম্বলের মধ্যে এক ঢোল, এক কাঁসি। তার আর সতর্কতার কি আছে!
বললাম, না, না। আমার সশস্ত্র পুলিসের কিছু দরকার নেই। এমনি দুটো সাধারণ কনস্টেবল দেবেন। তাইলেই হবে।
পুলিস সাহেব কথাটা শুনেই যেন বেশ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বললেন, না না। আপনি আপত্তি করবেন না। এই বাংলোয় সশস্ত্র পুলিশ রাখাই দস্তুর। একেবারে ওপর থেকে ব্যবস্থা।
জিগ্যেস করলাম, হঠাৎ, এই বাংলোর জন্যে এমন স্বতন্ত্র ব্যবস্থা কেন? তিনি বললেন, তা' জানি নে। আমি আসার আগে থেকেই এই ব্যবস্থা চলে আসছে।
পুলিস সাহেব ভাঙলেন না বটে, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই ব্যাপারটা জানতে পারলাম! আমার ভৃত্য গিরিধারী জেদ করতে লাগল, আমার শোবার ঘরের মেঝেতেই সে শোবে।
-কেন রে?
গিরিধারীকে খুব বিচলিত মনে হল। বললে, হাঁ হুজুর, এইখানেই শোব। জায়গাটা ভালো নয়।
-কেন, খারাপটা কি?
গিরিধারী জানালে, বাড়িটা ভূতুড়ে।
ওর একটা সুবিধে আছে, যা' আমার নেই। পাঁচ-ছয় দিন হল এখানে এসেছি, কিন্তু কয়েকজন সরকারী কর্মচারী এবং আমার কাছারির জনকয়েক উকিল ছাড়া আর কারও সঙ্গে এ পর্যন্ত পরিচয় করে উঠতে পারিনি। কিন্তু গিরিধারী এরই মধ্যে শহরের অর্ধেক লোকের পরিচিত।
বাজার করতে গিয়ে পাঁচজনের কাছ থেকে খবরটা সে সংগ্রহ করে এনেছে।
বললাম, ভূতুড়ে কি রকম! এই পাঁচ-ছয় রাত্রি কাটালো, এর মধ্যে কিছু দেখেছিস? আমি তো দেখিনি।
গিরিধারীও স্বীকার করতে বাধ্য হল, সেও কিছু দেখেনি।
-তবে?
তবে কি? গিরিধারীর বক্তব্য, পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে কিছু দেখা যায় নি বলে কোনোদিন যে দেখা যাবে না এমন তো কথা নেই। রাত্রে হুজুর যদি ভয় পেয়েই যান, তখন কি হবে? মায়ের কাছে জবাব তো তাকেই দিতে হবে!
কথাটা মিথ্যে নয়। সুতরাং তার আবদারে আমাকে রাজী হতে হল। খাটে আমি শুই। মেঝেয় শোয় গিরিধারী। পাশের ছোট ঘরটা, যেটা আমি অফিস- ঘর করেছি, সেইখানে সারারাত্রি একটা আলো টিম টিম করে জ্বলে। বাইরে জ্বলে একটা পেট্রোম্যাক্স। আর ফটকে দু'জন সশস্ত্র পুলিশ। আমি অনেকখানি, এবং গিরিধারীও খানিকটা, নিশ্চিন্ত হলাম যে আলো এবং মানুষের এই ব্যূহ ভেদ করে প্রবেশ করার সাধ্য ভূতের বাপেরও হবে না।
কিন্তু কী ভূত? কার ভূত?
গিরিধারী বললে, মেয়েলোকের।
-মেয়েলোকের! সে আবার কি!
-আজ্ঞে হাঁ হুজুর।
গিরিধারী এ সম্পর্কে যা' শুনেছিল, বললে। সেটা এই রকম:
কয়েক বৎসর আগে এখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেট এসেছিলেন। ভদ্রলোক অনেকগুলি বিবাহ করেছিলেন। তাঁদের কতকগুলি স্বাভাবিকভাবে, কতক অস্বাভাবিকভাবে মারা যান। তাঁর ব্যবহারে উত্ত্যক্ত হয়ে কয়েকজন পিতৃগৃহে চলে যান। এঁদের মধ্যে একজন এই বাংলোতেই নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। তারপর থেকে শ্বেতবসনা একটি মূর্তিকে কোনো কোনো রাত্রে বাগানে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। শহরের কোনো কোনো লোক দেখেছে। রাত্রে এই বাংলোয় যারা পাহারা দেয়, তাদেরও কেউ কেউ দেখেছে। মূর্তিটি যে ওই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অপমৃতা স্ত্রীর তাতে সন্দেহ নেই। কারণ তার গলায় একটা কালো ছিদ রয়েছে।
গল্পটা শুনতে শুনতে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল।
কিন্তু কয়েকজন সরকারী কর্মচারী এবং আমার কাছারির জনকয়েক উকিল ছাড়া আর কারও সঙ্গে এ পর্যন্ত পরিচয় করে উঠতে পারিনি। কিন্তু গিরিধারী এরই মধ্যে শহরের অর্ধেক লোকের পরিচিত।
বাজার করতে গিয়ে পাঁচজনের কাছ থেকে খবরটা সে সংগ্রহ করে এনেছে।
বললাম, ভূতুড়ে কি রকম! এই পাঁচ-ছয় রাত্রি কাটালো, এর মধ্যে কিছু দেখেছিস? আমি তো দেখিনি।
গিরিধারীও স্বীকার করতে বাধ্য হল, সেও কিছু দেখেনি।
-তবে?
তবে কি? গিরিধারীর বক্তব্য, পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে কিছু দেখা যায় নি বলে কোনোদিন যে দেখা যাবে না এমন তো কথা নেই। রাত্রে হুজুর যদি ভয় পেয়েই যান, তখন কি হবে? মায়ের কাছে জবাব তো তাকেই দিতে হবে!
কথাটা মিথ্যে নয়। সুতরাং তার আবদারে আমাকে রাজী হতে হল। খাটে আমি শুই। মেঝেয় শোয় গিরিধারী। পাশের ছোট ঘরটা, যেটা আমি অফিস- ঘর করেছি, সেইখানে সারারাত্রি একটা আলো টিম টিম করে জ্বলে। বাইরে জ্বলে একটা পেট্রোম্যাক্স। আর ফটকে দু'জন সশস্ত্র পুলিশ। আমি অনেকখানি, এবং গিরিধারীও খানিকটা, নিশ্চিন্ত হলাম যে আলো এবং মানুষের এই ব্যূহ ভেদ করে প্রবেশ করার সাধ্য ভূতের বাপেরও হবে না।
কিন্তু কী ভূত? কার ভূত?
গিরিধারী বললে, মেয়েলোকের।
-মেয়েলোকের! সে আবার কি!
-আজ্ঞে হাঁ হুজুর।
গিরিধারী এ সম্পর্কে যা' শুনেছিল, বললে। সেটা এই রকম:
কয়েক বৎসর আগে এখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেট এসেছিলেন। ভদ্রলোক অনেকগুলি বিবাহ করেছিলেন। তাঁদের কতকগুলি স্বাভাবিকভাবে, কতক অস্বাভাবিকভাবে মারা যান। তাঁর ব্যবহারে উত্ত্যক্ত হয়ে কয়েকজন পিতৃগৃহে চলে যান। এঁদের মধ্যে একজন এই বাংলোতেই নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। তারপর থেকে শ্বেতবসনা একটি মূর্তিকে কোনো কোনো রাত্রে বাগানে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। শহরের কোনো কোনো লোক দেখেছে। রাত্রে এই বাংলোয় যারা পাহারা দেয়, তাদেরও কেউ কেউ দেখেছে। মূর্তিটি যে ওই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অপমৃতা স্ত্রীর তাতে সন্দেহ নেই। কারণ তার গলায় একটা কালো ছিদ রয়েছে।
গল্পটা শুনতে শুনতে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল।
তবু গিরিধারীকে সাহস দেবার জন্যে বললাম, তুই পাগল হয়েছিস গিরিধারী? ভূত আবার আছে নাকি! ওরা সব ভুল দেখেছে।
-এত লোক সবাই ভুল দেখলে হুজুর? ওরা নিজের চোখে দেখেছে যে!
বিজ্ঞের মত বললাম, নিজের চোখেও ভুল দেখেরে বোকা। ভয় পেলে নিজের চোখেও ভুল দেখে। আমি নিজেই কতবার দেখেছি।
গিরিধারী সেইখানে বসে পড়ল। জিজ্ঞেস করলে, আপনিও ভূত দেখেছেন হুজুর?
ওর বসবার ভঙ্গী এবং ভয়ার্ত কণ্ঠস্বরে হেসে ফেললাম। বললাম, ভূত নয় রে ভুল দেখেছি। ট্যুর থেকে সাইকেলে ফিরছি, চাঁদের আলোয় মনে হল দূরে, রাস্তার ধারে একটা গরু চরছে। আর একটু আসতে মনে হল, গরু নয় বাছুর। . আরও কাছে আসতে মনে হল বাছুর নয়, চাদর মুড়ি দিয়ে একটা লোক বসে রয়েছে। খুব কাছে এসে দেখলাম, গরু বাছুর মানুষ কিছুই নয়-একটা মাটির ঢিবি, চাঁদের আলোয় ওই রকম লাগছিল।
আমি হাসতে লাগলাম। কিন্তু গিরিধারীর মুখ দেখে মনে হল, ও হতাশ হয়ে গেছে। আশা করছিল বোধ হয় একটা জমকালো ভূতের গল্পের। ধীরে ধীরে উঠে গেল।
একদিন দেখি, ও সশস্ত্র সেপাইদের একজনকে চায়ের লোভ দেখিয়ে রান্নাঘরে নিয়ে এসেছে। সেখানে একটা মোড়ায় বসে সেপাইটা চা খাচ্ছে আর গিরিধারী রান্না করছে। দু'জনে গল্পও চলছে।
বুঝলাম, ভয়ে।
ও যে রাত্রে আমার ঘরে এসে শোয়, এখন মনে হল তার সবটাই আমাকে ভূতের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্যে নয়, ওর মধ্যে আত্মরক্ষার প্রয়োজনও নিহিত রয়েছে। চাকরের ঘরে একলা শোবার সাহস ওর নেই।
একদিন রাত্রে, আমার তখনও ঘুম আসেনি, গিরিধারী হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসল।
আমি চমকে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কি রে?
গিরিধারী আমার কথার উত্তর না দিয়ে চকমক করে চারদিকে চাইতে লাগল।
•ও ঘেমে নেয়ে উঠেছে।
-কি হল রে?-আবার জিজ্ঞেস করলাম।
-আজ্ঞে, তেনাকে দেখলাম হুজুর।
ওর গলায় স্বর বেরুচ্ছে না। কোনো রকমে কথা কয়টা বললে।
-কাকে দেখলি রে?
-আজ্ঞে তেনাকে। পষ্ট দেখলাম গলার সেই কালো ফুটোটা।
গিরিধারীর চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে ভয়ে!
আমি জোরে জোরে হেসে উঠলাম। বললাম, পষ্ট দেখলি কি করে? তুই তো ঘুমোচ্ছিলি!
-আজ্ঞে না, ঘুমোইনি হুজুর।
আমি হেসে বললাম, ঘুমোসনি কিরে? তোর নাক ডাকার উৎপাতে আমি ঘুমোতে পারছিলাম না।
গিরিধারী পাশের ছোট ঘরটার দিকে চাইলে, যেটা আমার অফিস-ঘর।
সেখানে একটা আলো, যেমন নিত্য জ্বলে, আজও জ্বলছে। -এবং খোলা দরজা দিয়ে এ ঘরেও তার আলো এসে পড়েছে।
গিরিধারী তথাপি বললে, আজ্ঞে না হুজুর, আমি ঘুমোইনি। পষ্ট দেখেছি।
বলেই তখনই আবার শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল!
তারপরে আরও কয়েকমাস গেল।
গিরিধারী এখন অনেকটা সুস্থ ও স্বচ্ছন্দ হয়েছে। আর ভূত দেখে না, এমন কি, এখন সে আমার ঘর ছেড়ে নিজের ঘরেই গুচ্ছে। পূর্বতন ম্যাজিস্ট্রেট পত্নীর আত্মহত্যার বিবরণ আমারও মন থেকে মুছে গেছে।
দুর্গাপূজা হয়ে গেছে অনেক দিন। কালীপূজার রাত্রি।
গিরিধারী জোড় হাতে দাঁড়াল।
-কি রে?
-যদি একটু ছুটি দিতেন হুজুর, সিনেমায় যেতাম।
-যা।
গিরিধারী খুশির সঙ্গে চলে গেল।
বাইরের বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে বসে ছিলাম। সামনে সেপাইটা পাহারা দিচ্ছে। আমার মনটাই কি রকম খুশি-খুশি ছিল। আহা! ছুটির দিন, সবাই আনন্দ করছে। আর ও বেচারা বন্দুক ঘাড়ে করে নিয়মিত তালে ফটকের কাছে পায়চারি করছে।
ওকেও ছুটি দিলাম।
তারপরে বেতের চেয়ারটায় নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। সূর্য অস্ত গেছে অনেকক্ষণ। সামনের মাঠে কালো অন্ধকার নেমেছে। তার ওপারে জ্বলছে শহরের একখানা উঁচু বাড়িতে দেওয়ালীর আলোকমালা। কারা ছাদে তুবড়ি জ্বালাচ্ছে। তার আলোর ফুলঝুরি দেখা যাচ্ছে। আকাশে উঠছে হাউই। কত রকমের। কোনোটা অনেক উচুতে উঠে সশব্দে ফেটে গিয়ে উজ্জ্বল লাল-নীল
আলোর মালা তৈরি করছে। কোনোটা থেকে বেরুচ্ছে এক ঝাঁক আলোর মৌমাছি। উড়তে উড়তে মিলিয়ে যাচ্ছে।
আপন মনে দেখছি এই সব। হঠাৎ মনে হল কতকগুলো জরুরী কাজ রয়েছে যেগুলো আজ রাত্রেই সেরে রাখা দরকার। উঠলাম। গিরিধারী নেই। কিন্তু সমস্ত ব্যবস্থাই সে করে রেখে গেছে। শোবার-ঘর এবং অফিস-ঘর-দুটো ঘরেই আলো জ্বলছে।
শোবার ঘরের আলোটা কম-জোর করে দিয়ে অফিস-ঘরে গেলাম। সে- ঘরের আলোটা টিমটিম করে জ্বলছিল। আলোটা জোর করে দিতেই দেখলাম-
কী দেখলাম?
দেখলাম কাদার দাগ। তখনও কাঁচা রয়েছে। কে যেন একটা পা ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে হয় ওদিক থেকে এদিকে এসেছে, নয় এদিক থেকে ওদিকে গেছে!
থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
পূর্বতন আত্মঘাতিনী ম্যাজিস্ট্রেট-পত্নীর কথা এই কয় মাসে ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন মনে পড়ল, গিরিধারী যেন বলেছিল, সেই মহিলাটির একটি পা ছিল না। মস্তিষ্কের মধ্যে একটা তরঙ্গ চলে গেল তিনি নন তো! একটিমাত্র পা ছেঁচড়ে গেলে এমন দাগ হতে পারে।
মনে হওয়ামাত্র আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল।
আরও মনে পড়ল, গিরিধারীর কাছে যেন শুনেছিলাম, কত বৎসর আগে জানি না, এমনি একটা কালীপূজার অন্ধকার রাত্রেই ভদ্রমহিলা আত্মহত্যা করেছিলেন। কত বৎসর পরে সেই রাত্রি আজ আবার ফিরে এসেছে। ভাগ্যের চক্রান্তে আজকেই গিরিধারীকে ছেড়ে দিয়েছি।
চক্রান্ত বই কি! গিরিধারী না হয় সিনেমা দেখার জন্যে ছুটি চেয়েছিল। কিন্তু সেপাইটাকে ছেড়ে দিলাম কেন? সে তো ছুটি চায়নি!
কে জানে তারা কখন ফিরবে।
কিন্তু এই অন্ধকার রাত্রে, এই নির্জন পুরীতে ততক্ষণ আমার কাটবে কি করে? ভাবতেই আমার বুকের রক্ত জল হয়ে আসছিল।
আস্তে আস্তে পিছু-হটে শোবার ঘরে ফিরে এলাম।
না। ভয় পেলে চলবে না। সাহস সঞ্চয় করে রাখতেই হবে। এখানে সাহায্য
করবার জন্যে কাউকে পাওয়া যাবে না।
দূরে, পুলিস সাহেবের বাংলোতে দেওয়ালীর আলো জ্বলছে। তাঁর ছেলেরা দু'চারটে বাজিও পোড়াচ্ছে বোধ হয়। কিন্তু সে এত দূরে যে মানুষের কণ্ঠস্বর সেখানে পৌঁছবে না।
সুতরাং সাহস রাখতেই হবে। অন্ততঃ গিরিধারী কিংবা সিপাহী না ফেরা পর্যন্ত।
দেয়াল থেকে রাইফেলটা পেড়ে নিয়ে হাতের কাছে রাখলাম-এবং অপেক্ষা করতে লাগলাম।
কার জন্যে? গিরিধারীর জন্যে? সিপাহীর জন্যে? না কি সেই আত্মঘাতিনী ভদ্রমহিলার জন্যে?
কে জানে কার জন্যে?
দূরে, শ্মশানে একটা চিতা জ্বলছে। কার দিন শেষ হল কে জানে? সে কি খুবই বৃদ্ধ? জীবনের তেল একেবারে নিঃশেষ হয়ে এসেছিল? না কোনো তরুণ, কি তরুণী? তেল থাকতেও ঝড়ের ঝাপটায় যার জীবন-প্রদীপ গেল নিভে? ঘরে-ঘরে আজ আলোর মালা। কার ঘর রইল অন্ধকার?
বল হরি, হরি বোল!
উঃ! কী বিকট চীৎকার করে শব নিয়ে যায় এরা। বুকের ভিতরটা ঠক ঠক করে কেঁপে ওঠে!
হঠাৎ একটা শকুন-শিশু কচি ছেলের মতো ওঁয়া ওঁয়া করে কেঁদে উঠল। উঃ! সেই ভদ্রমহিলার কচি ছেলেও ছিল না কি? এইখানে মায়ের মতো তারও
কি অপমৃত্যু ঘটেছিল?
কিন্তু না, ভয়ে মুহ্যমান হলে চলবে না-সাহস রাখতেই হবে। রাইফেলটা শক্ত মুঠোয় ধরে বসে রইলাম।
তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে এসেছিল। কোণে টিপয়ের উপর কুঁজোয় জল। তার মাথায় কাঁচের গ্লাস। কিন্তু অতদূর যাবার আমার সামর্থ্য নেই। বহুকষ্টে পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরাবার চেষ্টা করলাম। ধরান কি যায়? হাতের
জ্বলন্ত দেশলাই ঠক ঠক করে কাঁপছে!
ভুলেই গিয়েছিলাম, কখন অন্যমনস্কভাবে খাট থেকে পা-দুটো ঝুলিয়ে বসেছিলাম। একটার পর একটা দেশলাই জ্বেলে যখন সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করছিলাম, তখন কে যেন আমার পায়ের তলায় আস্তে আস্তে সুড়সুড়ি দিলে!
জ্বলন্ত দেশলাই হাত থেকে পড়ে গেল। মুখ থেকে সিগারেটটাও।
সমস্ত দেহ কাঠের মতো শক্ত হয়ে গেছে।
মনে হল, পায়ের তলাকার সেই মৃদু স্পর্শ যেন বরফের তরঙ্গের মতো আমার সমস্ত দেহ ছড়িয়ে পড়ে মস্তিষ্কের দিকে দ্রুতবেগে ছুটেছে। অথচ দুরন্ত গুমোটে যেমন ঘাম ছোটে, তেমনি কল কল করে ঘামছি।
গলায় স্বর ফুটছে না।
আমি কি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি?
না না। এই হিমানী তরঙ্গকে কোনোমতেই মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছতে দেওয়া হবে না।
মনকে একটা প্রকাণ্ড ঝাঁকি দিয়ে বন্দুক হাতে খাট থেকে লাফিয়ে পড়লাম।
সমস্ত শরীর ঠক ঠক করে কাঁপছে তখনও। প্রচণ্ড শক্তিতে হারিকেনটা নিয়ে খাটের তলায় দেখতে হবে কি আছে! হারিকেনটা নিয়েছি। কিন্তু দেখব কি করে? কেমন যেন পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। কিছুতেই বেঁকছে না।
বাঁকাবার জন্যে শেষ চেষ্টা করতে যাব, এমন সময় দেখি-
আমরা এতক্ষণ দুরন্ত আগ্রহে নিঃশব্দে শুনে যাচ্ছিলাম চক্রবর্তীর কাহিনী। কিন্তু আর পারলাম না। একসঙ্গে চীৎকার করে উঠলাম কি? কি? কি?
শান্তকণ্ঠে চক্রবর্তী বললেন, কাছিম।
-কাছিম!
-আজ্ঞে হাঁ। বিরাটকায় একটা কাছিম।
চক্রবর্তী এতক্ষণ পরে একটা সিগারেট ধরালেন। দেশলাই নিভে যেতেই আবার অন্ধকার। নীরব, জমাট, এতকাল অন্ধকার। পায়ের নিচে সমুদ্র যেন তিমি মাছের মতো প্রকাণ্ড হাঁ করে বেলাভূমিকে গিলতে আসছে। তার সঙ্গে আমাদেরও কি?
হাতের টর্চটা জ্বেলে বললাম, চলুন ওঠা যাক্। রাত হয়েছে। -চলুন! সকলেরই কণ্ঠ হতাশায় মিইয়ে গেছে যেন।
No comments:
Post a Comment